ঈমান ও ইসলাম, তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত।

 

ঈমান ও ইসলাম, তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত

কাজী আবু হোরায়রা, খতিব, মসজিদে বায়তুল হারাম (জুমার খুতবা)

 

ইমানের আভিধানিক অর্থ বিশ্বাস। ইসলামের পরিভাষায় আল্লাহ তায়ালাকে সকল সৃষ্টির ¯্রষ্টা হিসেবে, সকল সৃষ্টির লালন পালনকারী হিসেবে, সকল সৃষ্টির জীবন ও মরনের মালিক হিসেবে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন এবং হজরত মুহাম্মদ (স:) কে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হিসেবে জানা ও মানার নাম হচ্ছে ঈমান। আর ইসলামের আভিধানিক অর্থ শান্তি। আর পরিভাষায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ তায়ালার আদেশ ও নিষেধ সমূহ যথাযথভাবে মেনে চলার নাম ইসলাম।

 

বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বয়ে ইসলাম। অর্থাৎ ঈমান বা বিশ্বাস শুধু থাকলেই মুসলমান হওয়া বা থাকা যাবেনা। যতক্ষন পর্যন্ত ঐ বিশ্বাসের প্রমান কর্ম বা আমল দ্বারা না হবে। ঈমান বা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে মাপকাঠিও জানতে হবে। অর্থাৎ ঈমান অর্থই হল অন্তরের বিষয়। অন্তরে আস্থা স্থাপন আর এর পরিধি ও শাখা-প্রশাখা পাঁচ কালেমায় রয়েছে, সর্বশেষ কালেমায় ঈমানের পরিধি উল্লেখ করে বলা হয়েছে“আমি বিশ্বাস স্থাপন করলাম এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেস্তাদের উপর তাঁর প্রেরিত কিতাব সমূহের উপর, তাঁর মনোনীত সকল নবী-রাসুলগণের উপর এবং পরকালের উপর এবং তাকদীর বা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ভাগ্যলিপির উপর এবং ভাগ্যলিপির ভাল-মন্দ সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘটে এর ওপর এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপর (অর্থাৎ ৫ম কালেমা কালেমায়ে ঈমানে মুফাসসাল)। পাঁচ কালেমার প্রথম ৪টিতে তাওহীদ ও রিসালাতের কথা বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন তিনটি প্রধান বিষয়ে বিশ্বাসী হলে ঈমানের অন্যান্য শাখাগুলোর বিশ্বাসী হওয়াটা সহজ হয়ে যায়। সে তিনটি হল:- ক) আল্লাহর একত্ত¡বাদে বিশ্বাসী হওয়া খ) রাসুলগণের রিসালাতে বিশ্বাসী হওয়া গ) পরকালে বিশ্বাসী হওয়া । যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে খালিক-মালিক হিসেবে এবং মুহাম্মদ (স:) কে আল্লাহ তায়ালার নবী ও রাসুল হিসেবে এবং এই জগতের কর্মের হিসাব পরকালে দিতে হবে এই দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে সে ব্যক্তি ঈমানের অন্যান্য শাখা যেমন আল্লাহর প্রেরিত কিতাব, প্রেরিত সকল নবী রাসুল, ফেরেস্তা, তাকদীর ইত্যাদির উপরও বিশ্বাস স্থাপন সহজ হয়ে যায়। সে কারনেই তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত এই তিনটিকে ঈমানের মূলনীতি বলা হয়ে থাকে।

 

উপরোল্লেখিত বিষয়গুলো সিহাহ্ সিত্তাহ্ এর হাদীস সমূহে বিস্তারিতভাবে এবং কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। সূূরা বাকারার প্রথমেই ঈমান বিল গায়িব অর্থাৎ তারাই মুমিন যারা আল্লাহকে না দেখেই বিশ্বাস স্থাপন করে। ঈমানের মুল কথাই না দেখে বিশ্বাস করা। এটাই ঈমানের পরীক্ষা। কারন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকেই ঈমানদার বলে গ্রহণ করবেন যারা বিশ্বজাহানের সৃষ্টি শূন্যের উপর একে একে ৭টি আসমান, নিচে পানির উপর সাত জমিন, অসংখ্য অগনিত বিষ্ময়কর সৃষ্টি এমনকি সৃষ্টির সেরা মানুষের সৃষ্টি রহস্য দেখে এর স্রষ্টা কে? তাঁকে না দেখেও তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে খুজে বের করুক ও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করে তার আদেশ নিষেধ মেনে চলুক তাহলেই সে প্রকৃত বিশ্বাসরূপে পরিগণিত হয়। যেমন আল্লাহ বলেন তার সব সৃষ্টির দিকে তাকালে তাঁকে খুজে পাবে। তুমি যাকে বাবা বলে ডাক সে যে তোমার বাবা তুমি কি তাকে দেখেছ যে সে তোমার জন্মদাতা? বুখারীর ২৯,৪৫ ও ১৫৮৮ নং হাদীসে, মুসলীমের ৪৭ নং হাদীস সহ শত শত দলিলে এবং পুরো কোরআনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ শুধু আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ, নবী মুহাম্মদ (স:) এর রিসালাত ও পরকালের উপর অবতীর্ণ আয়াত সমূহে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।

 

কোরআন হাদিসের বিশেষজ্ঞগণ ঈমানকে তিনভাগে ভাগ করেছেন।

ক) মৌখিক স্বীকৃতি যা কালেমায় তাইয়্যেবা ও অন্যান্য কালেমা সমূহের বাক্য দ্বারা ঘোষনা দেয়া যে আমি বিশ্বাসী।

খ) অন্তর দ্বারা বিশ্বাস স্থাপন: অর্থাৎ শুধু মুখে উচ্চারন নয় ঈমানের সকল অঙ্গসমূহের উপর অন্তর দ্বারা দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন এবং

গ) কাজে পরিনত করে দেখানো। অর্থাৎ মুখের স্বীকৃতি ও অন্তরের বিশ্বাস বাস্তব কিনা তা কাজে পরিনত করে অনুগত হওয়া। যেমন রুকু-সিজদাকারী হওয়া আল্লাহর আদেশ নিষেধ সমূহ তথা হলাল হারাম মেনে চলার নাম ঈমান।

এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, তাহলে ঈমান ও ইসলাম অর্থাৎ মুমিন ও মুসলিম দুটি নামে অভিহিত হল কেন? এর ব্যখ্যায় বলা হয়েছে।

ক) ঈমান হল বিশ্বাস আর ইসলাম হল কর্মের নাম।

খ) ঈমান হল ভিত্তি ইসলাম হল তার উপর নির্মিত দালান অর্থাৎ ঈমানের ভিত্তির ওপর কর্ম সম্পাদন করে ইসলামী জীবন গঠন।

গ) ঈমান হল একটি বৃক্ষের মূল কান্ড আর ইসলাম হল ঐ বৃক্ষের শাখা প্রশাখা।

ঘ) ঈমান হল জানার ও চেনার নাম আর ইসলাম হল মানার ও অনুগত হওয়ার নাম।

ঈমান ব্যতীত ইসলামের তথা কর্মের কোন পুরষ্কার বা মূল্যায়ন নেই। আর ইসলাম ব্যতীত ঈমানের স্বার্থকতা নেই। যাদের ঈমান নেই তারা হাজারো ভাল কাজ করলেও আখিরাতে তাদের কোন প্রতিদান নেই।

পৃথিবীতে অনেকেই অনেক ভাল কাজ করে, জনকল্যান করে, অনেক সৎ ও যোগ্য ব্যক্তির দাবীদার হয়। কিন্তু ঈমানের মূল ফাউন্ডেশন না থাকায় তারা পরকালের জন্য শূণ্য।

 

সুনাম ও সফলতা শুধু পৃথিবীর ক্ষনস্থায়ী জীবনে। আখিরাতে সফল হওয়ায় জন্য ঈমান অপরিহার্য। ঈমানের বিপরীত হল কুফরী।

 

তাওহীদ হল আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়া। তার সাথে যে কোন ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাউকে শরীক না করা। আল্লাহ তাঁর ঘোষনা চুড়ান্ত করেছেন যে, শিরককারীকে আল্লাহ ক্ষমা করবেননা অন্য যে কোন অপরাধ তিনি ক্ষমা করতে পারেন।

 

রিসালাত: মুহাম্মদ (সা:) আল্লাহর রাসূল। পৃথিবীর মানুষের নিকট আল্লাহর বার্তাবাহক। তাঁর উপর আল্লাহর কিতাব তথা কুরআন নাজিল হয়েছে। তিনি কোরআনের বানী ব্যাখ্যা করে এবং তাঁর কর্মের মাধ্যমে মানুষের জন্য জীবনাদর্শ দেখিয়েছেন। যারা তাঁর কথা কাজ ও অনুশীলন মানল তারা আল্লাহর দেয়া বিধান মানল আর যারা তাঁর দেয়া সুন্নাহ বা জীবন পদ্ধতি মানল না তারা শুধু তাঁকে নয় পক্ষান্তরে আল্লাহকে অস্বীকার করল। কেননা তিনি শুধু আল্লাহর নির্দেশিত কথাও কাজ করেছেন। নিজের ইচ্ছায় কিছুই করেননি। এছাড়া রাসুল (সা:) কে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবীও রাসুল হিসেবেও মেনে নিতে হবে।

 

আর আখিরাততো পরবর্তী চিরস্থায়ী জগৎ। মৃত্যুর পর পুনরুত্থান হবে এবং পার্থিব জীবনের হিসাব দিতে হবে। হিসাবের পর ফলাফল ঘোষনার দ্বারা সফলকামীগণ জান্নাতের তথা চির সুখের অধিবাসী হবে আর যারা ঈমান ও আমল না থাকার  কারনে দোষী সাব্যস্ত হয়ে জাহান্নামী হবে চিরদিনের জন্য। শেষ বিচারের পরের চির জীবনকেই আখিরাত বলা হয়।

কোন মন্তব্য নেই

sebastian-julian থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.