জুময়ার দিন ও জুময়ার রাতের আমল।

 জুময়ার দিন ও জুময়ার রাতের আমল


দিন আগে না রাত আগে, এ ব্যাপারে জানা প্রয়োজন যে, বাংলা ও ইংরেজী মাস গণনায় দিন আগে আসে। এজন্য আমরা কথা প্রসঙ্গে বলি দিবাগত রাত। কিন্ত আরবী মাসের গণনায় রাত আগে দিন পরে আসে। সেজন্য জুময়ার দিনের রাত হল পূর্বরাত অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত। এ রাতের মর্যাদাও অন্যান্য রাতের চেয়ে বেশী। তবে রমজান মাসের রাত সমূহ, জিলহজ¦ মাসের প্রথম দশ দিনের রাত সমূহ, লাইলাতুল বারাত, ওলাইলাতুল কদরের ফযিলতের কথা আলাদা। যে ব্যক্তি নিয়মিত রাত জেগে ইবাদত করে তার নিকট জুময়ার রাতের ইবাদত অধিক ফযিলতের। কারণ অন্যান্য রাতে না জেগে শুধু জুময়ার রাতে জাগ্রত হয়ে ইবাদতের জন্য নিদিষ্ট করার ব্যাপারে রাসুল (সাঃ) নিরুৎসাহিত করেছেন। অনিয়মের কারনে এতে শারীরিক-মানসিক সমস্যা হতে পারে। হাদীসে নিয়মিত কম আমলেরও অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। একইভাবে শুধু জুময়ার দিনে রোজা রাখাকেও নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। জুময়ার দিনের আগে বা পরে দুুদিন বা একদিন মিলিয়ে রোজা রাখতে বলা হয়েছে।


জুময়ার দিনের ফযিলতঃ

জুময়ার দিনের নেয়ামত ও ফযিলত বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। এ নেয়ামত আল্লাহ তায়ালা শুধু উম্মাতে মুহাম্মদীকে দান করেছেন। আল্লাহ্ তায়ালার হিকমত মানুষ বুঝতে সক্ষম নয়। কারণ জুময়ার দিনটিকে সপ্তাহের বড় দিন হিসেবে গ্রহণ করার জন অতীতের দুটি বড় জাতিকে এ সুযোগটি দেয়া হয়েছিল। ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরা তা গ্রহন করেনি। ইয়াহুদীরা শনিবারকে ও খৃষ্টানরা রবিবারকে বড় দিন হিসেবে গ্রহন করে। আল্লাহর দেয়া অফারকে তারা প্রত্যাখ্যান করে, ফলে আল্লাহতায়ালা ঘোষনা করলেন যে এ নিয়ামত তোমাদের জুটলা না, এর হকদার হয়ে গেল উম্মতে মুহাম্মদী। আসুন দেখি এ দিনের অগনিত নেয়ামত গুলোর সংক্ষিপ্ত কিছু আলোচনা করা যাক।

রাসুল (সা) বলেছেন “সূর্যের নিচে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হল জুমার দিন। এদিনেই আল্লাহ আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করেছেন। এদিনে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান এবং এদিনে তাঁকে জান্নাত থেকে বের করা হয়। ” (মুসলিম-২/৫৮৫)। 

অপর একটি হাদীসে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এরশাদ করেন “ জুময়ার দিনটি অন্য সব দিনের সরদার বা নেতা আল্লাহ্ তায়ালার নিকট সবচেয়ে মর্যাদাবান দিন হল জুময়ার দিন। এমনকি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনের চেয়েও অধিক মর্যাদার। এ দিনের ৫টি বৈশিষ্ট রয়েছে। ক) এ দিনে আল্লাহ্ সর্বপ্রথম মানুষ (আদম আঃ) কে সৃষ্টি করেছেন। খ) এ দিনেই আদম (আঃ) কে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। গ) এ দিনেই আদম (আঃ) এর মৃত্যু হয়। (ঘ) এ দিনে এমন একটি সময় আছে যে সময়ে বান্দাহ আল্লাহ্র নিকট যা চাইবে তাই আল্লাহ্ তাকে দান করবেন, যদি সে চাওয়া কোন হারাম বস্তুর জন্য না হয়। ঙ) এদিনে কেয়ামত সংঘঠিত হবে। আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত ফেরেশতাগন, আকাশ, জমিন, বাতাস, পাহাড়, সমুদ্র সহ প্রত্যেকটি সৃষ্টি কেয়ামত সংঘঠিত হয়ে যাওয়ার ভয়ে প্রতি শুক্রবার বা জুময়ার দিন সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে”। ইবনে মাজাহ-১/৩৪৪

অপর একটি হাদিসে রাসুল (সাঃ) বলেন, “ তোমাদের দিনগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম দিন শুত্রবার কাজেই এ দিনে তোমরা আমার উপর বেশি করে দরুদ পাঠ করবে। তোমাদের দরুদ আমার উপর পেশ করা হয়। কোন এক প্রশ্ন কারী বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) আপনার মৃত্যুর পর আপনিতো কবরের মাটির সাথে মিশে যাবেন- সে অবস্থায় আমাদের দরুদ আপনার নিকট পেশ করা হবে ?  এর জবাবে রাসুল (সাঃ) বলেন, না না কোন নবীর দেহ মাটির সঙ্গে মিশে যাবে না। আল্লাহ তায়ালা মাটির জন্য নবীদের দেহ ভক্ষন করা হারাম করে দিয়েছেন। তাই তোমাদের দরুদ আমার নিকট ফেরেশতা পৌঁছে দেবে এবং আমি তোমাদের সালামের ও জবাব দেব (আবু-দাউদ-১/২৭৫)।

তিনি আর ও বলেছেন, “ যদি কোন মুসলমান সুন্দরভাবে জুময়ার দিন গোসল ও অযু করে এবং আগে আগে জুময়ার নামাযে উপস্থিত হয় এবং নীরবে মনোযোগের সাথে ইমামের বয়ান শুনে তবে সে ঐ জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত ৭ দিন এবং অতিরিক্ত ৩ দিনের মধ্যে যত সগীরা গুনাহ্ হয় সব সগীরা গুনাহ ক্ষমা করা হবে। আর যদি সে খুতবার মধ্যে কথা বলে এমনকি কোন কাঁকর স্পর্শ করে তবে সে জুময়ার সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে (মুসলিম-২/৫৮৮)


 রাসুল (সাঃ) আরও বলেছেন, “ যদি কেউ জুময়ার দিনে উত্তম রুপে গোসল করে এবং প্রথম প্রহরেই মসজিদে রওয়ানা দেয় এবং সামনের দিকে যেখানে খালি জায়গা পায় সেখানে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে সে একটি উট কুরবাণী করার সমান সওয়াব লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি দ্বিতীয় প্রহরে মসজিদে উপস্থিত হবে সে একটি  গরু কোরবাণীর সমান এবং যে তৃতীয় পর্যায়ে গমন করল সে একটি শিং ওয়ালা ছাগল/ভেড়া কোরবানীর সমান এবং যে ৪র্থ পর্যায়ে গমন করে সে একটি মুরগী দান করার সমান সওয়াব লাভ করল। আর যে পঞ্চম পর্যায়ে গমন করে সে একটি ডিম দান করার সমান সওয়াব পাবে । আর যখন ইমাম বা খতীব বয়ান শুরু করেন তখন ফিরিশতাগন সওয়াব লেখা বন্দ করে দেন ও বয়ান শুনেন (বুখারী-১/৩০১ মুসলিম-২৫৮২)।

আগেই বলেছি জুময়ার দিনের মর্যাদা ফযিলত ও সওয়াবের বর্ণনা লিখে শেষ করা যাবে না। তবে জুময়ার ফযিলত অর্জন করতে হলে যে সব কাজ করনীয় ও বর্জনীয় সেগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরব।



করনীয়ঃ

ক) ভালো ভাবে গোসল করা। খ) মিসওয়াক করা। গ) সুগন্ধি ব্যবহার করা। ঘ) উত্তম পোশাক পরিধান করা। ঙ) জুময়ার নামাজের জন্য মসজিদে আগে আগে যাওয়া। চ) ধীর স্থীর ভাবে হেঁটে হেঁটে মসজিদে যাওয়া। ছ) জুময়ার দিনে দোয়া কবুলের প্রতিশ্রæত মূহুর্তটি লাভের আশায় আল্লাহর নিকট তওফিক চাওয়া ও দোয়া করা (বিশেষ করে খুতবার শুরু থেকে চলে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এবং আসরের নামাজ থেকে সূর্যাস্তের আগের সময় পর্যন্ত সতর্ক থেকে দোয়া করা) । জ) জুময়ার দিন গোসলের পূর্বে হাত পায়ের নখ কাটা।

ঝ) খুতবার (বয়ানের সময় থেকে দ্বিতীয় খুতবা শেষ হওয়া পর্যন্ত) সময় চুপ থাকা। এমনকি কোন প্রয়োজন হলে মুখে কিছু না বলে হাতের ইশারায় বলা , অন্য কেউ কিছু বললে বা বলতে চাইলে মুখ বন্ধ অবস্থায় মুখের উপর আঙ্গুলি রেখে বুঝানো যে এখন কথা বলা যাবেনা। আর তা না করে যদি চুপ থাকুন বা চুপ হোন বললেও জুময়ার সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে।

ঞ) মসজিদে গিয়ে যেখানে খালি জায়গা থাকে সেখানেই দাঁড়ানো বা বসে যাওয়া।

ট) জুময়ার দিন নামজের পূর্বে অথবা পরে সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করা।

ঠ) ইমামের কাছে বা নিকটে বসার চেষ্টা করা যাতে বয়ান ও খুতবা শ্রবণ সহজ হয়। জুময়ার নামাজে খুতবা শোনা ও চুপ থাকাকে বাধ্যতা মূলক করা হয়েছে।

ড) আসরের নামাযের পর ৮০-১০০ বার দরুদে উম্মি পাঠ করা (আল্লাহুমা ছাল্লি আলা মুহাম্মাদিনিন্ নাবিয়্যিল উস্মিয়্যে)।


জুময়ার দিন করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলিঃ

১। ভাল করে গোছল ও মিসওয়াক না করা।

২। উত্তম পোশাক ও সুগন্ধি থাকার পরও সেগুলি ব্যবহার না করা।

৩। কোন ওযর নেই, তারপর ও জুময়ায় না গিয়ে যোহরের নামায পড়া।

৪। ঘরে বা কোন কাজে ব্যস্ত হয়ে জুময়ায় দেরীতে যাওয়া।

৫। দেরীতে মসজিদে গিয়ে মানুষকে কষ্ট দিয়ে সামনে যাওয়ার চেষ্ট করা।

৬। ইমাম বা খতীব সাহেবের বয়ান ও আরবী খুতবার সময় কথা বলা।

৭। খুতবার সময়ে কথা না বললেও অন্য কোন কাজ করা।

৮। মসজিদে হৈ চৈ বা হট্টগোল করা।

উল্লেখিত কাজগুলো পরিহার করলে জুময়ার ফজিলত লাভে ইনশায়াল্লাহ্ আমরা সক্ষম হব।


জুময়ার নামাজ যাদের উপর ফরজ তারা একাধারে তিন জুময়া ত্যাগ করলে তাদের অন্তরে সীলমোহর পড়ে যাওয়ার ব্যাপারে হাদীসে সতর্ক করা হয়েছে। অর্র্থাৎ তাদের হিদায়েতের পথ রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে এবং তাদের নাম মুনাফিকের কাতারে লেখা হয়ে যেতে পারে। একটি হাদীসে বর্ণিত আছে, যে ব্যাক্তি জুময়ার দিনের সুন্নাত কাজ গুলো ভালোভাবে আদায় করে সওয়াবের আশায় জুময়া আদায় করতে যায়, তাদের প্রতি এক কদমের পরির্বতে পূর্ণ এক বছরের  রোজার ও পূর্ণ এক বছরের রাতে জাগ্রত হয়ে ইবাদত করার সমতুল্য সওয়াব লাভ করবে (তিরমিজী)। জুময়ার দিনকে দুই ঈদের দিনের চেয়েও উত্তম এবং সাপ্তাহিক ঈদের দিন ও গরীব মুসলমানদের জন্য হজ্জের সাথে তুলনা করা হয়েছে । এ দিনটিকে অতুলনীয় মর্যাদাবান করে যে উম্মতকে দেওয়া হয়েছে তারা এর মর্যাদা না দিলে আল্লাহ তায়ালা তাদের দুনিয়া ও আখিরাতে মর্যাদাহীন করে দিলে আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ জুময়ার শব্দের অর্থ একত্রিত হওয়া বা একত্রিত করা। অর্থাৎ আল্লাহ্ তায়ালা এ দিনে মসজিদে ঈমানদারদের একত্রিত হতে বলেছেন। আবার শীমাহীন নেয়ামত, বরকত ও রহমত তিনি এদিনের মধ্যে একত্রিত করে রেখেছেন। জুময়ার দিবসটি শুধু পুরুষের জন্য ফযিলতের নয়, মহিলাদের জন্য ও ফযিলতের । জুময়ার দিন পর্দার সাথে মসজিদে যাওয়ার সুযোগ থাকলে তারা মসজিদে যাবেন। আর সে সুযোগ না থাকলে ঘরে যোহরের নামায আদায় করে দোয়া-কালাম, তিলাওয়াত ও ফযিলতপূর্ণ সব আমল করবেন। আল্লাহ্ সকল মুসলমানদের এসব নিয়ামত অর্জনের তওফিক দিন।

কোন মন্তব্য নেই

sebastian-julian থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.